ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পেছনের রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিল অরণি। বৃষ্টির পরের সেই বিকেলটা ছিল অসম্ভব সুন্দর—আকাশে ছিল মেঘের খেলা, বাতাসে ছিল শীতলতা। এমন সময় হঠাৎ করেই পেছন থেকে ডাকা পড়ল,
—"অরণি! এক মিনিট দাঁড়াও।"
অরণি ঘুরে দেখল, তৌসিফ ছুটে আসছে। ক্লান্ত নিশ্বাস, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা।
—"কী হলো? এমন দৌড়াচ্ছ কেন?" —"তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই। খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু।"
অরণির চোখে একটু কৌতূহল ফুটে উঠল। তৌসিফ সাধারণত শান্ত, কম কথা বলা ছেলেদের দলে পড়ে। আজ তার মুখে একরকম তীব্রতা। অরণি অপেক্ষা করল।
—"আজ ৫ আগস্ট। চার বছর আগে এই দিনেই আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, মনে আছে?"
অরণি একটু চুপ করে থাকল। মনে পড়ছিল সেই দিনটার কথা।
চার বছর আগে, ৫ আগস্ট
বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিনও। মল চত্বরের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল অরণি। বৃষ্টির ছাঁট লেগে ওর জামা ভিজে যাচ্ছিল। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এক অপরিচিত ছেলে। হাতে ছিল লাল রঙের ছাতা।
—"তুমি কি ছাতা আনোনি? আসো, আমার ছাতার নিচে দাঁড়াও।"
অরণি অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার দিকে। প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল, চোখদুটো কেমন যেন গভীর, মায়াবী। এরপর ধীরে ধীরে পরিচয়, বন্ধুত্ব। তারপর কখন যেন একটা অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়েছিল তারা।
বর্তমানে ফিরে আসা
অরণি মৃদু হাসল। "হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু আজ তুমি এত উত্তেজিত কেন?"
তৌসিফ একটু ইতস্তত করল, তারপর একদম সামনে এসে দাঁড়াল।
—"আমি আর দেরি করতে চাই না, অরণি। চার বছর ধরে আমরা একসঙ্গে আছি, বন্ধুত্বের ছলে, আড়ালে ভালোবাসার গোপন অনুভূতি নিয়ে। কিন্তু আর লুকিয়ে রাখতে চাই না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আজকের দিনটাই উপযুক্ত মনে হলো বলার জন্য।"
অরণির বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এতদিন ধরে এই অনুভূতির কথা দুজনেই বুঝত, কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলেনি। আজ তৌসিফ বলে দিল।
বাতাসের শীতলতা যেন আরও বেড়ে গেল। চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
অরণি চোখ নামিয়ে ফেলল, একটু হাসল, তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,
—"তোমার কি মনে আছে, চার বছর আগে ছাতাটা ধরেছিলে তুমি? এবার আমিও তোমার জন্য ছাতা ধরতে চাই, সারাজীবনের জন্য।"
তৌসিফ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর হেসে বলল,
—"তাহলে আজকের দিনটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বিশেষ দিন হয়ে থাকুক।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রাস্তা বৃষ্টিভেজা হয়ে রইল, আর তার মাঝে গড়ে উঠল এক চিরন্তন প্রেমের গল্প।
প্রেমের পরের অধ্যায়
তাদের প্রেমের গল্প সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যস্ত দিনগুলোতে একসঙ্গে বসার সময় কমে গিয়েছিল। ক্লাস, পরীক্ষা, পড়াশোনার চাপের মাঝে নিজেদের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তবুও, প্রতিদিন বিকেলে মল চত্বরে কিছুক্ষণ একসঙ্গে কাটানোর চেষ্টা করত তারা।
একদিন, তৌসিফ বলল, "অরণি, জানো, তোমাকে ছাড়া কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি করিডোর মনে করিয়ে দেয় আমাদের গল্প। আমি চাই না আমাদের গল্প এখানেই শেষ হোক।"
অরণি মৃদু হেসে বলল, "তাহলে আমাদের গল্পটাকে দীর্ঘ করো। কিভাবে?"
তৌসিফ একটু চুপ করে থাকল, তারপর গভীরভাবে অরণির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, "বিয়ে করবে আমাকে?"
অরণি চমকে উঠল। সে ভাবেনি এত দ্রুত এই প্রশ্ন আসবে। যদিও তাদের ভালোবাসা গভীর ছিল, তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যায় শেষ হবার পর কী হবে, তা নিয়ে তারা কখনও খোলাখুলি আলোচনা করেনি।
—"তোমার কি মনে হয়, আমরা প্রস্তুত?"
তৌসিফ মৃদু হেসে বলল, "ভালোবাসা প্রস্তুতির অপেক্ষা করে না, অরণি। এটা অনুভূতির ব্যাপার। আমি জানি, আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। পরিবার, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যতের চিন্তা। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যদি আমরা একসঙ্গে থাকি, সবকিছুই সম্ভব হবে।"
অরণির চোখে জল চলে এলো। এই ছেলেটা সত্যিই তাকে ভালোবাসে, নিঃস্বার্থভাবে। সে মাথা নাড়ল, "হ্যাঁ, আমি রাজি।"
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হলো। তাদের প্রেম শুধু একটা ক্যাম্পাস রোমান্স হয়ে থাকল না, বরং জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল।
শেষ কথা
বছর কেটে গেল, তারা দুজনেই নিজেদের ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু প্রতিটি ৫ আগস্ট, তারা ফিরে আসে সেই একই জায়গায়, যেখানে তাদের প্রেমের গল্প শুরু হয়েছিল।
কার্জন হলের পেছনের সেই রাস্তা, মল চত্বর, ঢাবির চায়ের দোকান—সবকিছুই তাদের স্মৃতির অংশ হয়ে রইল। আর তাদের ভালোবাসার গল্প হয়ে থাকল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়।
Comments
Post a Comment